বৈদিকযুগের শেষের দিকে সামাজিক বৈষম্য ও জাতিভেদ প্রথা এবং যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে তার আদর্শকে ভিত্তি করে ভারতবর্ষে নাস্তিক ও আস্তিক ধারায় প্রায় ৬৩টি ধর্মমতের উদ্ভব হয়, যার মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জৈনধর্মের উদ্ভব, জৈন ধর্মের মূল শিক্ষা এবং জৈন ধর্মের প্রভাব বা গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি।
জৈনধর্মের উদ্ভব, মূল শিক্ষা ও প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ
জৈন ধর্মের উদ্ভব :
জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম প্রায় সমসাময়িক। মহাবীরকে জৈনধর্মের প্রবর্তক বলে মনে করা হলেও, জৈনরা মনে করেন যে, তাঁর আগেও তেইশজন তীর্থঙ্কর অর্থাৎ মুক্তির পথপ্রদর্শক জৈনধর্মকে পুষ্ট করেছিলেন। সর্বপ্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদের বা আদিনাথ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হলেন মহাবীর। এই চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে বাইশ জনের কোনও ঐতিহাসিক সন্ধান পাওয়া যায় না। ত্রয়োবিংশ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথ সম্বন্ধে জৈন ধর্মগ্রন্থে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়।
পার্শ্বনাথ :
পার্শ্বনাথই প্রকৃতপক্ষে জৈনধর্মের সূচনা করেন। তাঁর সম্বন্ধে এটুকু জানা যায় যে, তিনি কাশীর কোনও রাজার সন্তান ছিলেন এবং মহাবীরের জন্মের প্রায় আড়াইশো বছর আগে তাঁর জন্ম হয়। ত্রিশ বছর বয়সে পার্শ্বনাথ রাজপ্রাসাদের ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন এবং তিন মাস কঠোর তপস্যার পর পূর্ণজ্ঞান লাভ করেন। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যে উপদেশ প্রচার করেন তা চতুর্যাম নামে খ্যাত।
মহাবীর :
জৈনধর্মের শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর। তিনি পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত ধর্মের সংস্কার করেছিলেন মাত্র। তাঁর মুখ্য ভূমিকা ছিল সংস্কারকের। পার্শ্বনাথ প্রচারিত চতুর্যাম আদর্শের সঙ্গে মহাবীর আরও একটি আদর্শ যোগ করেন এবং তা হল শুচিতা বা ব্রক্ষ্মচর্য। ৩০ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে দীর্ঘ ১২ বছর কঠোর সাধনার পর তিনি কৈবল্য বা সিদ্ধিলাভ করেন এবং জিন বা জিতেন্দ্রিয় নামে পরিচিত হন।
আনুমানিক ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বে বিহারের মজঃফরপুর জেলায় মহাবীরের জন্ম হয়। ছোটো বেলায় তাঁর নাম ছিল বর্ধমান। কৈবল্য ও পরম জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি সুখদুঃখ ও পঞ্চ রিপুকে জয় করেছিলেন বলে তাঁকে মহাবীর বলা হয় এবং জিন থেকে তাঁর অনুগামী এবং শিষ্যরা জৈন নামে পরিচিত হন।
কৈবল্য লাভ করার পর তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের মগধ, কোশল, অঙ্গ, মিথিলা, নালন্দা, বৈশালী, রাজগৃহ প্রভৃতি স্থানে ধর্মপ্রচার করে বহু নরনারীকে জৈনধর্মে দীক্ষিত করেন। তৎকালীন রাজারাও তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে রাজগীরের নিকটবর্তী পাবা নামক স্থানে তিনি অনশনে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাটলিপুত্রে আহ্বান করা জৈনদের এক সভায় মহাবীরের উপদেশগুলি বারোটি অঙ্গে বা খণ্ডে সংকলিত করা হয়, যা 'দ্বাদশ অঙ্গ' নামে খ্যাত। 'দ্বাদশ অঙ্গ' প্রাকৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল।
জৈনধর্মের মূল শিক্ষা :
পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত চতুর্যাম নীতি [যথা : অহিংসা, সত্য, অচৌর্য (চুরি না করা) ও অপরিগ্রহ (বিষয় সম্পত্তি থেকে মুক্ত থাকা)] এবং মহাবীর প্রবর্তিত ব্রক্ষ্মচর্য মোট এই পাঁচটি নীতি বা 'পঞ্চ মহাব্রত' হল জৈনধর্মের মূলভিত্তি। জৈনধর্মের মতে, সত্য বিশ্বাস, সত্য জ্ঞান এবং সত্য আচরণ—এই তিনটি গুণ হল মানুষের ত্রিরত্ন। এই তিনটি গুণ বা ত্রিরত্নের সাহায্যে পরম শুদ্ধ আনন্দ বা আত্মার মুক্তি অর্থাৎ 'সিদ্ধশিলা' লাভ করা যায়। জৈনধর্মে বেদের অভ্রান্ততা, যাগযজ্ঞের কার্যকরীতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। তবে এই ধর্ম হিন্দুদের মতো কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। কৃচ্ছসাধনকেই জৈনরা শাশ্বত সত্যকে জানার একমাত্র উপায় বলে মনে করেন। জৈনধর্মমতে বিশ্বাস করা হয় যে, 'পঞ্চমহাব্রত' পালন ও কৃচ্ছসাধনের দ্বারাই কর্ম ও জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জৈনধর্মে সামান্যতম কীট হত্যাকেও মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়।
জৈনধর্মের প্রভাব :
ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর জৈনধর্মের প্রভাব ছিল অপরিসীম, কারণ :
(i) জৈনধর্মেই সর্বপ্রথম বর্ণ-বিভক্ত ভারতীয় সমাজের বুকে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা প্রচার করা হয়।
(ii) সৎ কাজকর্মের মাধ্যমেই সব মানুষই মোক্ষলাভ করতে পারবে—জৈনধর্মের এই শিক্ষা সমাজকে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মিথ্যাচার প্রভৃতির কলুষ প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পেরেছিল।
(iii) জৈন তীর্থঙ্কররা সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে তখনকার দিনের কথ্য পালি ও প্রাকৃত ভাষায় শিক্ষাদান করতেন, ফলে বহু স্থানীয় ভাষা সমৃদ্ধিলাভ করেছিল। জৈন ধর্মশাস্ত্রগুলি প্রাকৃত ভাষায় রচিত হলেও জৈনধর্মের বিস্তারের মাধ্যমে কেবলমাত্র প্রাকৃত ভাষাই নয়, —মাড়োয়ারি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু ও কানাড়ি ভাষাও সমৃদ্ধ হয়েছিল।
(iv) জৈনধর্মের অহিংসার আদর্শ ও যুদ্ধের অপ্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত ভাবনা চিন্তা প্রচারের ফলে পশুহত্যা বন্ধ হয় এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে।